বিদেহি প্রেমিকা(অষ্টম পর্ব)
সপ্তমপর্বলিঙ্ক http://pradipstories.blogspot.in/2016/09/blog-post_87.html
#Pradip Kumar Biswas
অষ্টম পর্ব
# ভুতের গল্প #Bengali
ghost story
চোর এসেছে মনে করে আমি এবার ফরমায় এলাম। বিছানা থেকে লাফ
দিয়ে নেমে দরজার কোনে রাখা একটা মোটা লাঠি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
ততক্ষণে অন্য রুমে ও বাকি সবাই টের পেয়ে বেরিয়ে এসেছে। ছাদে
যাবার সিঁড়িতে একটু এগিয়ে দেখি ছাদের দরজা বন্ধ এবং তালা লাগানো। বন্ধ দরজার বেশ কাছে এসে আমরা
সবাই কিন্তু শুনলাম চাপা গলায় কেউ যেন কাউকে ডাকছে। আমাদের মধ্যে তারিক গেল ছাদের
দরজার চাবি আনতে ।
কিন্তু সিনিয়র দাদা আমাদের বারন করলেন ছাদের দরজা খুললেই
বিপদ হতে পারে। এমনটা হতে পারে যে ছাদে এসেছে তার দলের লোকদেরও এখানেই এক এক করে আসার কথা । চোর
ডাকাতরা তো অ্যাকশনে নামার আগে একবার সবাই এক জায়গায় জড়ো হয় । দাদা বললেন আমাদের এখন শোনা উচিত এই
গ্যাং কি করতে চায়?
ওনার কথা শেষ হয় নি তার আগে নারী কণ্ঠে চাপা কান্নার
আওয়াজ শোনা গেল। প্রথমে মৃদু পরে কিন্তু বেশ
স্পষ্ট । এমন কি তারিক যে ছাদের দরজার চাবি আনতে গেছিল সেও শুনতে পেয়েছে ।
এই কান্না শুনে আমরা সবাই তো বেশ বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। তা হলে
ব্যাপারটা কি?
তারিক নিচে গিয়ে যা দেখেছে ফিসফিস করে আমাদের বলল। সব
শুনে তো আমরা একই সাথে হতভম্ব আর বিভ্রান্ত
হয়ে গেলাম।
ছাদের চাবি সাধারণতঃ রান্নাঘরে মিট-সেফে থাকে। কিন্তু
তারিক চাবি সেখানে পায়নি । চাবি ছিল অনিলের বিছানায় । শুধু তাই নয় । দুপুরে অনিলের
চলে যাবার খবর পেয়ে আমরা সবাই ওর রুমে গিয়ে দেখেছি যে ওর বিছানার কাছে ছোট সাইড টেবিলে ওর প্রিয়
ট্রান্সরিসিভার সেটটি হেলায় পড়ে আছে।
তারিক কিন্তু
ভাল করে দেখেছে ওই সেটটি অনিলের ঘরে তো নেইই পুরো ঘর খুঁজেও দেখে নি। তবে কি চোরেরা কোনও ভাবে এটা চুরি করেছে?
ওটা অনিল ছাড়া কেউ চালাতে পারবে না। ওদের এটা নিয়ে কোনও লাভ নেই ভেবে ফেলেই যাবে ।
আমরা ছাদের দরজার কাছে খুব সাবধানে কান
পেতে রইলাম।পরের মুহূর্তে যা আমাদের কানে এল সেটা যদি তখন যদি মেঘহীন আকাশে বাজ
পড়বার আওয়াজ শুনতাম তবে তাতেও আমরা অনেক
কম হতভম্ব হতাম।
নারী কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ তখন বেশ স্পষ্ট । “কেঁদো না প্লিজ” পুরুষ কণ্ঠের এই আওয়াজ চাপা
হলেও আমরা সবাই হলফ করে বলতে পারি এ আওয়াজ অনিল ছাড়া আর কারো নয় যার সাথে আমরা তিন
তিনটে বছর একই ক্লাসে, একই হোস্টেলে দিন কাটিয়েছি।
কিন্তু অনিল এখানে কিভাবে এল? ও কি তাহলে শেষ অবধি
গ্রামের বাড়ি না গিয়ে হয়ত ওর গ্রুপ
থিয়েটারের রিহার্সালে গেছিল? যে নারী কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে তা কি ওর কোনও সহ অভিনেত্রীর?
এই কান্নাটা কি নাটকের রিহার্সালের কিছু
যা ট্রান্সরিসিভারে শোনা যাচ্ছে? নিছক
রিহার্সাল দিতে কেউ নিজের ভাড়াবাড়ির ছাদে এভাবে একজন সহ-অভিনেত্রিকে সাথে নিয়ে
পাইপ বেয়ে কেন আসবে? হতে পারে ট্রান্সরিসিভার ছাদে পরিস্কার শোনা যায় সেই জন্য ও
কি ছাদে এসেছে? কিন্তু ছাদের দরজা তো চাবি দেওয়া ।
আমাদের সকলের মিলিত ফুস-ফাস থেমে গেল নারীকণ্ঠের কান্না
জড়ানো আবেগ ভরা সুরেলা অথচ চাপা গলার
আওয়াজ শুনে। গলার মডুলেশনটা এত ভালো যে চাপাগলায় বললেও একটু দূর থেকেও স্পষ্ট শোনা
যায় ।
“আমার একমাত্র আশ্রয় তো শেষ হয়ে গেল? তুমি, এই তুমিইতো
রাস্তা দেখিয়ে আনলে ওই ঠগগুলোকে”।
অনিল বলে “ শান্তিতে থাকার জন্য এই কাজটা করেছিলাম।তখন
বুঝি নি যে এর জন্য তোমাকে আশ্রয় হারাতে হবে ।আমায় ক্ষমা করে দাও তুমি”।
এই অবধি শুনে মনে হচ্ছিল এটা হয় নাটকের মহলা কিম্বা ওর
কোনও মনের মানবীর সাথে অন্তরঙ্গ আলাপ । আমাদের এভাবে আড়ি পাতা ঠিক হচ্ছে না।
আমরা যাবার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেলাম
তার পরের কথাগুলো শুনে। জানতাম না আমাদের জন্য এই মাঝ রাতে এত বিস্ময় অপেক্ষা
করছিল ।
নারীকণ্ঠ বলে “বলে দাও তুমি এখন আমি কোথায় থাকি? জানো তো
তুমি, বাজে গন্ধ, বেশি আলো আর আওয়াজ আমি
সহ্য করতে পারি না। বেশ ছিলাম আমি এই
বাড়ীর পেছনের বাগানে । বাড়ীর ছায়া দুপুর হলেই ঢেকে ফেলত পুরো বাগানকে।
লেবুপাতা আর ফুলের গন্ধে আমি বেশ ছিলাম। এর পর তুমি এলে। হাসি, গান আর আনন্দে ভরিয়ে দিলে আমাকে। আমার সেই আগেকার আনন্দের সময় ফিরে এল। ভাবি নি
সেই তুমি ই ...” করুন কান্নার মারু বেহাগ এবার দ্রুত তালে বেজে চার দিক ভরিয়ে তুলল। কিন্তু
অনিল তাকে দ্রুত সামাল দিল ।
কিন্তু আমরা সবাই মিলে এটা কি শুনলাম? নারী কণ্ঠটি কার? আমরা যা
বাক্যালাপ শুনলাম তাতে তো মনে হয় এটা কোনও নাটকের মহলা নয়।
তবে এই নারী কণ্ঠ যার
সে কি লেবুগাছে আশ্রয় নেওয়া
অশরীরী? তাহলে লেবুগাছে কি সত্যি কোনও অশরীরী ছিল?যা শুনছি সকলে তাতে সবারই মনে
হচ্ছে অনিলের সাথে তার তো বেশ একটা মিষ্টি মধুর রোমান্টিক সম্পর্ক। সে যদি অনিলের প্রেমিকা হবে তবে সে ললিতা
ভ্যাম্পকে অনিল সমেত আমাদেরকে কষ্ট দেবার কুবুদ্ধি কেন দেবে?
আমার রুমমেট অরুপের চাপা গলাতে অবিশ্বাস আর সন্দেহ ঝরে
পড়ে “অনিল আমাদেরকে উল্লু বানিয়েছে মনে হচ্ছে। আরে এই
মেয়েটা যদি পেত্নিই হবে তবে তার গলার আওয়াজ
তো খোনা খোনা হবে। আমরা যা শুনছি সেটা তো সত্যিকার মেয়েদের গলার মত আওয়াজ। আর তোরা ও
সেইরকম। পেত্নীর সাথে অনিলের প্রেমালাপ? কে বিশ্বাস করবে? সবাই শুনে হাসবে আর আমাদেরকে
বোকা ভাববে”।
আমাদের
সিনিয়র দাদা ইসারা করে চুপ করতে বলে “আমরা এই নিয়ে আলোচনাটা পরেও করতে পারি।এটা ওর
কোনও ব্যাক্তিগত ব্যাপার না অন্য কিছু সেটা বোঝার জন্য আগে আলাপটা আর একটু শুনে তো
নি”
এবার স্পষ্ট শুনলাম অনিলের কথা। ও বলছে “তুমি আমার সাথে
চল। গ্রামের বাইরে আলেয়াজলা নামে একটা পুরানো পুকুর আছে । রাতে ওই পুকুরে আগুন জ্বলে ওঠে কখন কখন।সেখানে কেউ
যায় না বড় একটা । পুকুর পাড়ে অনেক সাদা টগর, হাস্নুহানা আর জুঁই ফুলের গাছ আছে।
শান্ত সুন্দর পরিবেশ, তোমার খুব ভাল লাগবে। ”
“ আর তুমি, তুমি তো সেখানে থাকবে না। তুমি তো এই বাড়িতে তোমার
কাজ আর তোমার বন্ধুদের সাথে থাকবে।”
“ সারাদিনের কাজের শেষে আমি তোমার কাছেই থাকব।গরমের ছুটির
পর আমি যখন খড়গপুরে ফিরে যাব তখন তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব”
“ সেখানে আমার ঠাঁই কোথায় হবে?
তুমি তো হোস্টেলে থাকো।”
“হোস্টেলে আমার ঘর থেকে সামান্য দূরে মহুয়া, শাল, স্বর্ণচাঁপা আর গন্ধরাজের বনে ঢাকা এক পীরের পুরানো কবরস্থান
আছে। সেখানে কেউ কখনো যায় না। সেখানে তোমার থাকার জন্য একটা
সুন্দর জায়গা বেছেছি”।
আমরা জানি না আর
কতক্ষণ ধরে চলেছিল অনিলের এই রাতের রাদেভু। তবে সেটা শরীরী আর অশরীরী প্রেমিক
যুগলের বিদেহি প্রেমালাপ না আমাদের অজানা কোনও টেকনোলজির কারসাজি সে নিয়ে একটা আলো আঁধারি রয়েই
গেল ।
তবুও কোথাও যেন আমাদের নিজেদেরকে আড়িপাতা অপরাধী বলে মনে
হওয়াতে সবাই ছাদের সিঁড়ি ঘর থেকে নিজেদের রুমে ফিরে আসি।
নিচে নেমে এসে সবাই আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ওর
ট্রান্সরিসিভার কোনও রুমেই খুজে পেলাম না।তাহলে ওটা গেল কোথায়? এটা ওর ট্রান্স
রিসিভারের খেলা না আর কিছু সেটা ও এই নৈশ রাদেভুর পাট চুকিয়ে নিজের রুমে ঢুকলেই
তখন হাতেনাতে ধরা যাবে।
এই সব কিছু শোনার পর আজ
রাতে এমনিতেই ঘুম আর আসবেই না। আর আমরা চাইছিলাম অনিলের এই ব্যপারটার একটা
হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। কেউ যাতে
ঘুমিয়ে না পড়ি সেজন্য অন্ধকার ঘরে একটা
রুমের দুটো বিছানায় বসে রইলাম সবাই। মাঝে মধ্যে নিজেদের মধ্যে চাপাগলায় অনিলকে নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছিলই।পরদিন
কেন্দ্রীয় সরকারি ছুটি থাকাতে আমাদেরও ছুটি ।
সারা রাত জেগে কাটালেও অসুবিধে হবে না।
No comments:
Post a Comment