বিদেহিপ্রেমিকা(নবম ও শেষ পর্ব)
অষ্টম পর্বের লিঙ্ক
http://pradipstories.blogspot.in/2016/09/blog-post_97.html
#Pradip Kumar Biswas
নবম পর্ব
# ভুতের গল্প #Bengali
ghost story
পরদিন সকালে আমাদের রাঁধুনি গোবিন্দ চা এনে আমাদের ডেকে
তোলে। ও আসে সকাল সকাল । গোবিন্দের বাড়ি
অনিলের গ্রামেতেই । ভোর বেলায় ও ওখান থেকে বেরিয়ে পরলেও আমাদের এখানে এসে পৌঁছাতে
সামান্য বেলাতো হয়েই যায় । গোবিন্দের চা দিয়ে ডাকবার আওয়াজে শুধু আমি আর সিনিয়র
দাদা এই দুজনেরই ঘুম ভাঙ্গে । বাকিরা শেষ রাতে ঘুমে তলিয়ে পড়লেও এখন তাদের ঘুম
ভাঙ্গে নি।
দাদা আমাকে নিচু আওয়াজে বলে দিলেন আমরা যেন কেউ কালকের
রাতের অনিলের ব্যাপারটা নিয়ে গোবিন্দের সামনে কোনও আলোচনা যেন না করি।
রান্নাঘরের পাশেই অনিলের একক ঘর। গোবিন্দের কাছে আর এক কাপ চা চাইতে গিয়ে তার ওর
ঘরের টেবিলের ওপর চোখ পড়ে যায়। কি আশ্চর্য!
কাল আমরা সারা ঘর খুঁজেও অনিলের ট্রান্সরিসিভার খুজে পাই নি । এখন সেটা ওর টেবিলেই রাখা আছে দেখে আমি সবাইকে ডেকে তুলি।
সবাই ঘুম ভেঙ্গে উঠতেই গোবিন্দ সিনিয়র দাদার কাছে গিয়ে
তাড়াতাড়ি ফিরে যাবার ছুটি চায়। গোবিন্দ আর কিসব বলছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে দাদা আমাদের
সবাইকে তার রুমে ডেকে পাঠায়।
আমরা কেউ খাটে বসে কেউ মেঝেতে বসে গোবিন্দের কথা শুনছির
জায়গায় গিলছি বলাটা ঠিক হবে।
গোবিন্দ কাল সারারাত নাকি অনিলের বাড়িতেই ছিল ।অনিল জ্বর
নিয়েই নাকি কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে আসে। রাত্রে জ্বর বেশি হওয়াতে গোবিন্দ
পাশের গ্রাম থেকে ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসে । জ্বরের ঘোরে ও কি সব প্রলাপ বকেছে। তবে
পর পর দুটো ইঞ্জেকশান পড়ায় শেষ রাতের দিকে জ্বর একটু কমেছে।আসবার সময় অনিল
গোবিন্দকে বলেছে ওর একটা রেডিও আছে সেটা আমাদেরকে বলে ও যেন নিয়ে আসে।
গোবিন্দের কথা শেষ হতেই সিনিয়র দাদা পুরো ব্যাপারটা আর ভাল
করে জানবার জন্য বললেন “গোবিন্দ, অনিলের জ্বর শুনে তুমি ঠিক কখন গেছিলে?”
“তখন সন্ধ্যে হবে হবে করছে। আমাদের পাশাপাশি ঘর। ওদের বাড়ি থেকে চিৎকার শুনে আমি আর আমার মা
দুজনেই দৌড়ে ওদের বাড়ি এসে দেখি অনিল খুব জ্বরে কাবু হয়ে হাত পা ছুড়ছে। আমার মা
আমাকে নিতাই ডাক্তারকে ডেকে আনতে বলে” ।
“সেই সময় ওর কাছে কেউ ছিল?”
“ আমার মা ওকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। ওকে এই
অবস্থায় দেখে ওর মাথার কাছে বসে মাথায় জলপটি দিয়ে সমানে হাওয়া করে গেছে সারারাত”।
“ তুমিও ছিলে সেখানে ওর কাছে সারা রাত”।
“ হ্যাঁ আমি আর মা পালা করে সারারাত ওর মাথার কাছে ঠায়
বসে।অনিলের দাদা- বউদি ও আমাদের সাথে প্রায় পুরোটাই ছিল। এর
মাঝে নিতাই ডাক্তার দু বার এসে ওকে ইনজেকশন দিয়ে গেছে”।
গোবিন্দ আমাদের জন্য জলদি কিছু খাবার বানাবার জন্য রান্নাঘরে যাচ্ছিল সেই
সময় অরুপ ফস করে বলে ওঠে “গোবিন্দ, অনিলের বাড়ি থেকে পেতির জলা কত দূরে?” প্রশ্ন
শুনে আমরা সকলে ওকে থামিয়ে দিই। কথার পিঠে কথা বেড়ে অনিলের কালকের রাতের রাদেভু না
আবার ফাঁস হয়ে যায়? ।
গোবিন্দ ওর কথা শুনে হাত দুটো কপালে ঠেকিয়ে বলে “ সকাল
সকাল ওই সব জায়গার নাম নেওয়া উচিত নয়। ওটা তেনাদের জলা, অনিলদের বাড়ি থেকে সামনেই।
রাতে-ভিতে ওই পুকুরের জলে আগুন জ্বলে। গুনিনরা বলে ওসব জিনিস পেত্নিদের খেলা,
দেখলে অমঙ্গল হয়। সে জন্যেই দিন-মানেও ও কেউ ওখানে যায় না। তা আপনারা কি করে ওর নাম জানলেন?অনিল তাহলে
বলেছে আপনাদেরকে”।
এমনিতেই কালকের রাতের ছাদের এপিসোড, আমাদেরকে জুন মাসের দার্জিলিঙের
কুয়াশা আর মেঘে ঢাকা জ্বলাপাহাড়ের পাহাড়ি রাস্তাটার খাদের ধারে এনে ছেড়ে দিয়েছে । তার
ওপর গোবিন্দ এখন যা বলল তাতে আমাদের মনে কুয়াসার মেঘ আর ঘন হয়ে গেল।তবুও আমরা সকলে
মিলে একসাথে যৌথ চিন্তা-ভাবনা আর ব্যাপারটা নিয়ে কাটা-ছেঁড়া সুরু করলাম যদি কিছু
বোঝা যায়।
অনিল যে কাল রাতে সশরীরে ওর গ্রামের বাড়িতেই ছিল তা নিয়ে
কোনও সন্দেহ নেই। কালকে রাতে আমাদের এই বাড়ীর ছাদে আমরা সাদা চোখে না দেখলেও পুরুষ
কণ্ঠটি যে অনিলের তাতেও কোনও সন্দেহ নেই । কিন্তু একই মানুষ একই সময়ে দুটো ভিন্ন
ভিন্ন জায়গায় থাকে কি করে?তবে কি কাল যার কণ্ঠস্বর শুধু শুনেছিলাম সেটা কোনও ভুতের
খেল? প্রেত-মায়া? কিন্তু সে এই রকমটা খামোখা করবে কেন?
তারিক, কাল রাতে
যে প্রথমে নিচে ছাদেওর দরজার চাবি আনতে গেছিল সে বলে “অনিলের ট্রান্সরিসিভারটা
সে রাত্রে আমরা কেউ সারা ঘর বার বার খুঁজেও পাই নি। আবার পরদিন সকালে সেটা ওর
টেবিলেই পাওয়া যায়। সারা রাত তাহলে অনিলের সেটটা কার কাছে ছিল?”
আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে দাদা বললেন “ওই সেটটা চালাবার
গোপন কৌশলের চাবিকাঠি অনিল নিজের কাছেই রেখেছে। অন্য কেউ
সেটা নিয়ে যাবেই বা কেন? আর যদি নিয়ে যায় ও তবে সেটা আবার ফিরে এল কি করে? দোতলার
ঘরের বাইরের দরজার দুটো চাবির একটা অনিলের কাছে আর একটা গোবিন্দের কাছে।গ্রামের
বাড়িতে যাবার সময় অনিল চাবিটা আমার
বালিসের তলায় রেখে গেছে”।
তাহলে সেই রাত্রে কি অনিল এই দোতলার বাড়িতে আসে নি?ছাদে
হুবহু অনিলের কণ্ঠস্বর যে আমরা শুনলাম সেটা কার?একজন শরীরী মানুষ কি অশরীরীর
প্রেমে পড়তে পারে?
আফসোস
একটাই। আমরা যদি সৌজন্যতা না করে একটু অভদ্র হয়েই যদি কাল রাত্রে সিঁড়ির দরজার
তালা ধীরে খুলে একটু পা টিপে এক দু জন একটু এগিয়ে গেলেই চাক্ষুষ দেখা যেত এই
রহস্যময় ব্যাপারটা । সেটা না করায় আমরা সেই ধোঁয়াশার চাদরের
মধ্যেই রইলাম ।
একটু পরে গোবিন্দের সাথে অনিলের গ্রামের বাড়িতে ওকে
দেখতে গিয়ে আর থাকতে না পেরে আমরা ওকে সোজাসুজি এই ব্যাপারে জিজ্ঞেসই করেছিলাম।
আগের মত ও প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে না গিয়ে সোজাসুজি বলে দিয়েছিল “ এ সব তোদের বোঝার
বাইরে । এটা আমার নিজের ব্যাপার। তোরা চিন্তা করিস না” ।
আমরা এই নিয়ে আর কেউ কোনও কথা বলিনি আর । কিন্তু সে দিন
ওর ঘরে যে জানালার কাছে আমি বসেছিলাম এক অজানা মিষ্টি-মধুর গন্ধ আমার নাকে বার বার আসা-যাওয়া করছিল ।
এই ঘটনার অনেক বছর পর ইন্দোনেশিয়াতে নিকেল অনুসন্ধানে
গিয়ে এক জঙ্গল ক্যাম্পে অনিলের সাথে দেখা হয়ে গেছিল।ওর তাঁবুতে বসে সারারাত গল্প করেছি দু জনে।
চিরকুমার আপনভোলা এই জগদ্বিখ্যাত ভু-বিজ্ঞানীর সাদাসিধে
জীবনধারাতে কোনও প্রসাধনীর গন্ধ কোনোদিনই ছিল না।
ওর
গ্রামের বাড়িতে নাকে আসা সেই অজানা মিষ্টি মধুর গন্ধ ওর সাথে আবার দেখা হবার সেই রাত্রেও বারবার আমি
পেয়েছিলাম ।হয়ত সেই বিদেহি
প্রেমিকা ওর চিরসঙ্গিনি হয়ে গেছে।
।